টিউলিপ সিদ্দিককে দেশে ফিরে আদালতের মুখোমুখি হতে হবে: প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস
-
আপলোড সময় :
১৪-০৬-২০২৫ ০৫:৩১:০৭ অপরাহ্ন
-
আপডেট সময় :
১৫-০৬-২০২৫ ০৩:১৮:৩৬ অপরাহ্ন
ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও টিউলিপ সিদ্দিক। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকার ঘিরে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনার ঝড় উঠেছে। লন্ডনে অবস্থানকালে ব্রিটিশ চ্যানেল আইটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি সরাসরি বলেন, যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির এমপি টিউলিপ সিদ্দিককে দেশে ফিরে দুর্নীতির মামলায় আদালতে হাজির হয়ে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। রাজনৈতিক সংলাপ নয়, যেকোনো অভিযোগ মোকাবেলা করতে হবে আদালতের কাঠগড়ায়—এমন বার্তা দিয়ে তিনি যেন এক নতুন যুগের সূচনা করলেন, যেখানে নিকট আত্মীয়দের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠলে তার প্রতিকার খোঁজা হবে রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যেই।
এমন বক্তব্য একজন এমপি বা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার মুখ থেকে আসা অস্বাভাবিক নয়—তবে তা যদি হয় জাতির ইতিহাসে দীর্ঘকাল প্রভাব ফেলে যাওয়া একটি রাজনৈতিক পরিবারের সদস্যকে ঘিরে, তখন বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মাত্রাও বেড়ে যায়। টিউলিপ সিদ্দিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৌহিত্রী এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি। তিনি যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে বেশ সক্রিয় ও গ্রহণযোগ্য একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত, অতীতে ট্রেজারি মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
তবে সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানিয়েছে, টিউলিপ সিদ্দিক তার খালা শেখ হাসিনার কাছ থেকে অবৈধভাবে জমি ও ঢাকার গুলশানে একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট গ্রহণ করেছেন। এসব সম্পদ বৈধভাবে তার নামে হস্তান্তরের কোনো প্রামাণ্য দলিল পাওয়া যায়নি বলেই কমিশনের দাবি। এই অভিযোগ সামনে আসার পরপরই টিউলিপ এক বিবৃতিতে বলেন, এটি বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের ‘রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার’।
প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস অবশ্য স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, এই বিষয়টি এখন সম্পূর্ণভাবে আইনি পরিসরে চলবে। তিনি আইটিভির সাংবাদিককে বলেন, “আমি তার (টিউলিপের) সঙ্গে কোনো বৈঠকে বসিনি, বসার প্রয়োজনও অনুভব করিনি। কারণ এটি একটি আইনি ইস্যু। আমি আদালতের বাইরে গিয়ে এসব আলোচনায় জড়াতে রাজি নই।”
এই সাক্ষাৎকারের আগে টিউলিপ একটি চিঠির মাধ্যমে ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিলেন। তার যুক্তি ছিল, ঢাকার দুর্নীতি দমন কমিশনের অভিযোগে কিছু ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে, যা আলোচনার মাধ্যমে নিরসন করা সম্ভব হতে পারে। তবে ইউনূস সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এই প্রত্যাখ্যানকে কেন্দ্র করে টিউলিপ এক বিবৃতিতে বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা যদি সত্যিই স্বচ্ছতা ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নিতেন, তবে তিনি অন্তত আমার সঙ্গে একবার দেখা করতেন। তার এই অনীহা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণাকে উৎসাহিত করছে।”
টিউলিপের এই প্রতিক্রিয়াকে অনেকে একটি আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক বক্তব্য বলেও ব্যাখ্যা করছেন। কারণ, তিনি সরাসরি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, যার প্রভাব লন্ডনের রাজনৈতিক মহলেও পড়েছে। তবে ড. ইউনূস শুরু থেকেই বলে আসছেন, তার নেতৃত্বাধীন সরকার কোনোভাবেই প্রতিহিংসা বা দলীয় অবস্থান থেকে কাজ করছে না। তিনি সরকারের পক্ষ থেকে বহুবার বলেছেন, “আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা।”
এদিকে টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো এসেছে, সেগুলো নতুন নয়। ২০২৪ সালের ছাত্র-নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থানের পর যখন শেখ হাসিনার সরকার পতন হয়, তখনই তার পরিবারের একাধিক সদস্য ও ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ উঠে আসে। বিশেষ করে, দুর্নীতির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার, সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ এবং জাল দলিল তৈরি করে জমি ও ফ্ল্যাট গ্রহণের অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন। সেই ধারাবাহিকতায় টিউলিপ সিদ্দিকের নামও ওঠে আসে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়।
তবে এসব অভিযোগের কোনো প্রমাণ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি কমিশন। তাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে টিউলিপের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক নির্যাতনের অভিযোগও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তবুও বিষয়টি যখন আদালতের প্রক্রিয়ায় গড়ায়, তখন সেটি বিচারাধীন হওয়ায় এ বিষয়ে বাড়তি কিছু বলা যেমন সাংবাদিকদের জন্য সংবিধান পরিপন্থী, তেমনি রাজনৈতিক মন্তব্য করাও প্রশাসনিক দায়িত্ববোধের পরিপন্থী—এমনটি মনে করছেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
এই সমগ্র পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে ড. ইউনূসের স্পষ্ট অবস্থান। তিনি যখন আইটিভিকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন, তখন তার কণ্ঠে কোনো দ্বিধা ছিল না। বরং একজন প্রশাসক হিসেবে, একজন বিচারক হিসেবে এবং একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তার কণ্ঠ ছিল দৃঢ় ও পরিপক্ব। তিনি বলেন, “আমি এই মামলায় আমার ব্যক্তিগত মতামত চাপিয়ে দিতে চাই না। আমি চাই, এটি আইনের মাধ্যমেই সমাধান হোক।”
এই বক্তব্য অনেকের কাছে একটি বড় বার্তার মতো প্রতীয়মান হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বহুবার দেখা গেছে, প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবার বা আন্তর্জাতিক পরিচিতি সম্পন্ন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও তা আড়াল করা হয় প্রশাসনিক সদিচ্ছার অভাবে। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অন্তত বিষয়টি ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে বলেই মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
ড. ইউনূসের এই বক্তব্যের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কেউ কেউ তাকে ‘একজন সাহসী প্রশাসক’ বলে অভিহিত করেছেন, কেউ আবার বলছেন, “আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও বিচার ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে ইউনূস একটি কঠিন ও নৈতিক অবস্থান নিয়েছেন।” আবার কেউ কেউ বলেছেন, “এই বক্তব্য শুধু টিউলিপ নয়, সকল রাজনৈতিক পরিবারের জন্য একটি বার্তা—আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়।”
তবে টিউলিপ সিদ্দিকের ভবিষ্যৎ এখন অনেকটাই বাংলাদেশের আদালতের ওপর নির্ভর করছে। যদি তিনি দেশে ফিরে আইনি প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেন, তাহলে হয়তো নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার সুযোগ পাবেন। অন্যদিকে যদি তিনি আদালতের মুখোমুখি হতে রাজি না হন, তাহলে এটি তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে, এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টিও এ বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য দেয়নি। তবে বিষয়টি যদি আরও বহির্বিশ্বে আলোচিত হয়, তাহলে লেবার পার্টির ওপরও চাপ বাড়বে একজন এমপির আচরণ নিয়ে অবস্থান নিতে।
ড. ইউনূসের সাম্প্রতিক এই মন্তব্য, টিউলিপের প্রতিক্রিয়া এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক শুদ্ধাচারের নতুন এক দিকচিত্র উপস্থাপন করছে। যেখানে পরিচয় নয়, অপরাধই মুখ্য। যেখানে ক্ষমতা নয়, আইনের শাসনই চূড়ান্ত।
এই প্রেক্ষাপটে টিউলিপ সিদ্দিকের সামনে দুটি পথ—হয় আদালতের মুখোমুখি হয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে, নয়তো বিদেশি মাটিতে থেকেই বাংলাদেশের জনগণের বিশ্বাস হারাতে হবে। তবে শেষ কথা বলবে আদালতই—যেখানে দল নয়, প্রমাণই মুখ্য।
নিউজটি আপডেট করেছেন : নিজস্ব প্রতিবেদক
কমেন্ট বক্স